বইমেলায় একবার হুমায়ূন আহমেদকে দেখেছিলাম। অনেক বছর আগে। অন্যপ্রকাশের স্টলে বসে অটোগ্রাফ দিচ্ছেন। হুমায়ূন আহমেদের অটোগ্রাফ নেওয়ার শখ আমার ছোটবেলা থেকেই। একবার স্কুলের পিকনিকে গেলাম নুহাশ পল্লীতে। যদিও পিকনিকে যাওয়ার কোনো ইচ্ছাই ছিলো না আমার। স্যার বলেছিলেন, ‘ওখানে কে থাকবেন জানো? হুমায়ূন আহমেদ!’ শুনেই আমি রাজি হয়ে গেলাম। বহুকষ্টে রাজি করালাম মা-বাবাকে। গিয়ে দেখি কী সুন্দর নুহাশ পল্লী। সুইমিং পুল, পুকুর, ট্রি হাউজ, ঢাউশ দাবার বোর্ড সবই দেখলাম, কিন্তু হুমায়ূন আহমেদকে তো দেখি না। উনি কোথায়? স্যাররা বললেন, ‘আরে বোকা, উনার কি এত সময় আছে যে তোদের সঙ্গে বসে পিকনিক করবেন? উনি ঢাকায়।‘
সেটাও ঠিক। কী করা যায় তাহলে? নুহাশ পল্লীর কর্মীদের সঙ্গে কথা বলে খুঁজে বের করলাম হুমায়ূন আহমেদের ঘর। একটা চিঠি লিখে ঢুকিয়ে দিলাম সে ঘরের দরজার নিচ দিয়ে। উনি ঘরে ঢুকলে নিশ্চয়ই দেখবেন এবং আমার চিঠিটাই পড়বেন! কী দারুণ ব্যাপার! পরবর্তী কয়েকদিন খুব ভাবে ছিলাম – হুমায়ূন আহমেদকে চিঠি লিখেছি আমি! বন্ধুরাও পিঠ চাপড়ে দিতো – দোস্ত, তোর কী বুদ্ধি! ইশ! আমার নামে একটা চিঠি যদি লিখে দিতি!
কিন্তু চিঠি লিখলেও অটোগ্রাফ তো নেওয়া হয়নি। তাই সেদিন চোখের সামনে হুমায়ূন আহমেদকে দেখে অটোগ্রাফ নিতে খুব ইচ্ছে করছিলো। কিন্তু আমি নড়তে পারছিলাম না। প্রিয় লেখককে দেখার উত্তেজনা নয়, প্রচন্ড ভীড় এক কোণে আটকে রেখেছিলো আমাকে। এমনই ভীড় যে সামনে পেছনে কোথাও এগোনোর উপায় নেই। পুরো মেলাটা যেন হেলে পড়েছিলো অন্যপ্রকাশের স্টলের সামনে। চিৎকার, চেঁচামেচি, ধাক্কাধাক্কি। সবাই সামনে যেতে চাইছে। আমরা কোনোমতে এক কোণায় দাঁড়িয়ে আছি। অন্য স্টলের বিক্রেতাদের মুখে বিস্ময়। অনেকে বিশ্বাসই করতে পারছে না যে হিমু-মিসির আলির লেখক তাদের সামনে।
করার কথাও না। তখন প্রায় প্রতিদিনই মেলায় যেতাম। প্রতিদিনই গুজব শোনা যেত – আজ হুমায়ূন আহমেদ আসবেন। সবার মধ্যে একটা উত্তেজনা। কোথাও একটু জটলা দেখলেই মনে হতো, এই বুঝি হুমায়ূন আহমেদ এসেছেন। ছুটে গিয়ে দেখতাম, টিভি ক্যামেরায় সাক্ষাৎকার দিচ্ছে কেউ।
অথচ সেদিন সত্যি সত্যি হুমায়ূন আহমেদ এসেছিলেন। মনে আছে বেশ কয়েকবার চেষ্টা করেও সামনে যেতে ব্যার্থ হয়েছিলাম আমরা। তারপর সিদ্ধান্ত নিলাম, এখানেই দাঁড়িয়ে থাকি। পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রনের বাইরে চলে যাচ্ছিলো দেখে হয়তো দ্রুত চলে গেলেন হুমায়ূন আহমেদ। তবু আমরা আরও কিছুক্ষণ সেখানে দাঁড়িয়ে ছিলাম। যারা অটোগ্রাফ পেয়ে বিশ্বকাপজয়ের হাসি হাসছিলো, তাদের দেখে আফসোস করছিলাম, আর ভাবছিলাম পরেরবার দেখা অটোগ্রাফ নেবোই।
পরে অনেকবার বইমেলায় গিয়েছি, যাচ্ছি। কিন্তু অটোগ্রাফ আর নেওয়া হয়নি, হবেও না। এখন বইমেলায় ঘুরতে ঘুরতে হঠাৎ করেই মনে হয়, কেন ঘুরছি শুধু শুধু? গতবারও ‘এই বইটা সংগ্রহে নেই’ ভেবে ‘নক্ষত্রের রাত’ কিনেছি। পরে দেখি বুকশেলফে আরও একটি ‘নক্ষত্রের রাত’ আগে থেকেই বসে আছে। এবারও কি তাই হবে? স্টলগুলোতে হুমায়ূন আহমেদের বইগুলোর স্থান পরিবর্তিত হচ্ছে। ধীরে ধীরে মাঝখান থেকে এক কোণায় চলে যাচ্ছে বইগুলো। পেছনে ছোট হয়ে আসছে হুমায়ূন আহমেদের ছবির আকৃতি। আস্তে আস্তে সামনে আসছে এমন সব কথাসাহিত্যিক যাদের কথা কেন, নামও শুনিনি কোনোদিন। তবুও মেলায় যাচ্ছি কেন কে জানে। সেদিন বন্ধুকে জিজ্ঞেসও করলাম, ‘বলতো, কার বই পড়বো আমরা?’ বন্ধু কোনো উত্তর দিতে পারলো না। মনে হয় এই প্রশ্নের উত্তর আমাদের জানা নেই।
0 Comments