পৃথিবীর সব দেশে আইন থাকলেও আইনের প্রয়োগ সব জায়গায় হয় না। যেমন বাংলাদেশ। তেমনি সব দেশে বই থাকলেও অধিকাংশ দেশেই বইমেলা হয় না। অল্প কিছু দেশে অবশ্য বইমেলা হয়, তবে আমাদের একুশে বইমেলার মতো এত লোক সমাগম হয় না। এই ক্ষেত্রে আমাদের সাফল্য ঈর্ষণীয়। বাংলাদেশের মানুষ বই ধরুক বা না ধরুক, পড়ুক বা না পড়ুক, বইমেলায় আসে। আর মানুষ আসে বলেই মাসব্যাপী বইমেলার প্রতিটি দিনে ১০ বা ততোধিক টিভি চ্যানেলে ‘বইমেলা প্রতিদিন’ টাইপের অনুষ্ঠান দেখানো হয়। চ্যানেলের নারী রিপোর্টাররা যথাযথ ভাবগাম্ভীর্য ও মেকআপ বজায় রেখে মেলায় আসা দর্শনার্থীদের ‘আপনি কেন মেলায় এসেছেন?’ কিংবা ‘মেলায় এসে কেমন লাগছে?’ টাইপের প্রশ্ন জিগ্যেস করেন। বইমেলার মতো রিপোর্টারদের এই প্রশ্নগুলোও ঐতিহ্যবাহী। নতুন নতুন চ্যানেল আসে, এক চ্যানেলের রিপোর্টার অন্য চ্যানেলে যান কিন্তু প্রশ্নের ধরন বদলায় না। এই ক্ষেত্রে রিপোর্টাররা বোধহয় বদলানোর পক্ষে নন। বইমেলার আরেক অপরিবর্তিত বস্তু হচ্ছে ধুলা। বছরের পর বছর ধরে বইমেলা হচ্ছে, কিন্তু ধুলার পরিমাণ কমানোর কোনো ব্যবস্থা হচ্ছে না। বিক্রেতাদের অনেকেই ধুলা থেকে বাঁচতে মুখে মাস্ক পরে বসে থাকেন। এর আরেকটা সুবিধা হলো, বিক্রি-বাট্টা খারাপ হলেও বিক্রেতার মনমরা মুখটা দেখা যায় না। তা ছাড়া মেলা শেষে লস খাওয়া প্রকাশকেরা বলতে পারবেন, ‘হায় রে, আমার এত পরিশ্রম-কষ্ট সব ধুলায় মিশে গেল।’মেলায় ঢুকতেই মাইকের গুরুগম্ভীর ঘোষণাগুলো সবার কানে আসে। তথ্যকেন্দ্র থেকে আসা এই ঘোষণাগুলোও দীর্ঘদিন ধরে অপরিবর্তিত রয়েছে। যেমন ‘মেলার বিদ্যুৎকর্মীর দৃষ্টি আকর্ষণ করছি, আপনাকে তথ্যকেন্দ্রে যোগাযোগ করতে বলা হচ্ছে’ কিংবা ‘মেলার নজরুল মঞ্চে চলছে একটি নতুন বইয়ের মোড়ক উন্মোচন। বইটি লিখেছেন অমুক, প্রচ্ছদ করেছেন তমুক।’ তবে শুধু মেলা নয়, চাইলে বাড়িতেও এই ঘোষণাগুলোর প্রচলন ঘটানো সম্ভব। যেমন বাসার বিদ্যুৎ চলে গেলে বলা যেতে পারে ‘এলাকার বিদ্যুৎ কর্মীর দৃষ্টি আকর্ষণ করছি, আপনাকে বিদ্যুৎ সংযোগ দিতে বলা হচ্ছে।’ কিংবা বাজার থেকে কেনা মুরগির চামড়া ছেলার সময় বলা যায় ‘রান্নাঘরে একটি নতুন মুরগির মোড়ক উন্মোচন চলছে। মুরগিটি কিনেছেন বাবা, জবাই করেছেন ড্রাইভার চাচা এবং মোড়ক উন্মোচন করছেন রহিমার মা।’
পাটবস্ত্র মেলায় যেমন পাটবস্ত্রসংক্রান্ত স্টল থাকে, তেমনি বইমেলায় থাকে বইয়ের প্রকাশনীর স্টল। তবে এর সঙ্গে ইদানীং যোগ হয়েছে টিভি চ্যানেল, রাজনৈতিক সংগঠন, কাগজের দোকানসহ আরও কিছু স্টল। কিছু মানুষ ভিড় করে টিভি চ্যানেলগুলোর স্টলে রাখা টিভিতে খবর কিংবা সংগীতানুষ্ঠান দেখে। দেখে মনে হয় এই মানুষগুলো বাড়ির নারী সদস্যদের দ্বারা নির্যাতিত। মানে বাড়ির নারী সদস্যদের হিন্দি সিরিয়ালপ্রীতির কারণে তারা হয়তো বাংলাদেশের খবর বা অনুষ্ঠান দেখতে পারে না। তাই বইমেলায় এসে এক ঢিলে দুই বা ততোধিক পাখি মারার সুযোগ হাতছাড়া করে না কেউ। তবে এই টিভি চ্যানেল টাইপের অপ্রকাশনীগুলোকে জায়গা করে দেওয়ার জন্য জায়গা ছেড়ে দিতে হয় অনেক প্রকাশনীকেই। তার পরও মেলায় রয়েছে বিভিন্ন নাম ও ধরনের অসংখ্য প্রকাশনী। এত স্টলের ভিড়ে কাঙ্ক্ষিত প্রকাশনীর স্টল খুঁজে পেয়ে অনেকেই আবেগে আপ্লুত হয়ে পড়ে। মেলায় আসা দুই বন্ধুর কথোপকথন—
: দোস্ত, পাইসি। আয়, অবসরে যাই।
: মানে? চাকরির দুই মাসও হয় নাই। এখনই অবসরে যাব কেন?
: ধ্যাৎ। অবসর প্রকাশনীর কথা বলছি।
অন্যদিকে জনৈক ভদ্রলোক তাঁর ছেলেকে নিয়ে এসেছেন মেলায়। অনিচ্ছা সত্ত্বেও ছেলের চাপে মেলায় এসে ভিড় আর ধুলায় বেশ বিরক্ত তিনি। এমন সময় ছেলে বলে উঠল—
: আব্বা, ওই যে সন্দেশ!
: তুই জানোস না, আমার ডায়াবেটিস? আয় এদিকে!
এই বলে ভদ্রলোক জোর করে তার ছেলেকে নিয়ে এলেন পাঠ্যপুস্তকের স্টলে। বেচারা ছেলেটার মন খারাপ হয়ে গেল। নীরস পাঠ্যপুস্তক থেকে রেহাই পেতে বইমেলায় এসেও রেহাই নেই। এইখানেও পাঠ্যবইয়ের স্টল? ছেলে হতাশ। ভদ্রলোক খুশি। এই না হলে বইমেলা! তবে পাঠ্যপুস্তকের স্টল রাখলেও শিশুদের বইমেলা এবং বইয়ের প্রতি আগ্রহী করে তুলতে কর্তৃপক্ষ অত্যন্ত সচেতন। অন্যান্য বারের মতো এবারও মেলার একটি অংশকে ‘শিশু কর্নার’ হিসেবে ঘোষণা করেছে মেলা কর্তৃপক্ষ। তবে শিশু কর্নারে শিশুদের আনাগোনা সব সময় না থাকলেও সেখানে সব সময় কয়েকজন পুলিশ-সদস্যকে বসে থাকতে দেখা যায়। আসলে অনেকেই পুলিশকে বেশ কাঠখোট্টা-গম্ভীর মনে করে। কিন্তু পুলিশের ভেতরেও যে শিশুর মতো কোমল মন থাকতে পারে, শিশু কর্নারে পুলিশের উপস্থিতি তারই প্রমাণ। পুলিশরা দিনরাত শুধু যে চোর-ডাকাত ধরে বেড়ায় তা কিন্তু নয়। সূক্ষ্ম শিল্পকর্ম এবং সাহিত্যচর্চায়ও তাদের ভালো দক্ষতা রয়েছে। বইমেলাতেই পুলিশের লেখা বিভিন্ন বই নিয়ে একটা স্টলও আছে। শিশু কর্নার ছাড়া এই আরেকটা জায়গা, যেখানে পুলিশকে বসে থাকতে দেখা যায়। তবে একটি বিশেষ মহলের ধারণা, বইমেলায় সবচেয়ে বেশি বই চুরি হয় ঢাকা মেট্রোপলিটন পুলিশের স্টল থেকে! পুলিশ জনগণের বন্ধু। বন্ধুকে নিয়ে একটু ঠাট্টা-তামাশা করা দোষের কিছু নয়। কিন্তু ভুলে গেলে চলবে না, এই পুলিশ-সদস্যদের কারণেই কিন্তু মেলা এত নিরাপদ এবং ঝামেলামুক্ত।
0 Comments